শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
The Daily Post

অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের পথে কুষ্টিয়ার চিনিকল 

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের পথে কুষ্টিয়ার চিনিকল 

অযত্ন অবহেলায় অর্ধশতাব্দীর বয়সের ভারে ন্যুব্জ যান্ত্রিক ত্রুটি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার অভিশাপ নিয়ে কুষ্টিয়া সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। এরপর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটির দিকে নজর নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন কেবলই ধ্বংসস্তূপে রূপ লাভের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। এভাবেই বলছিলেন বন্ধ হয়ে যাওয়া কুষ্টিয়া চিনিকলের কর্মহারা ভুক্তভোগী শ্রমিকরা।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেই কারখানার ইনচার্জ জানালেন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারখানা ভবনগুলোর বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেগুলি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। উনারা পরিদর্শনও করে গেছেন কয়েকবার। এসব রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পেলেই মেরামত করা হবে।

কুষ্টিয়া চিনিকলের দাপ্তরিক সূত্রে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশপত্রে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে জানানো হয় চিনি উৎপাদন, আখের জমি হ্রাসকরণ, মিলের ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা, লোকসান ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকলসহ দেশের ৬টি চিনিকল ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে আখ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদন স্থগিত করে সরকার।

সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে আখ মাড়াই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য অর্থ ব্যয় করা লাগবে ৫৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে চিনি মোলাসেসসহ বায়োপ্রডাক্ট খাত থেকে ২৫০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আয় হলেও অবশিষ্ট ২৮৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সরকার থেকে ভর্তুকি দেয়া লাগবে।

উল্লেখ্য, এমনিতেই পূর্ববর্তী অর্থবছরে চাষিদের আখ ক্রয়ে ভর্তুকি বাবদ ১২৩ কোটি টাকা অনুমোদন হলেও তা ছাড় না করায় আখ চাষিদের পাওনাদি, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা বকেয়ার বোঝা চেপেই থাকে চিনিকলের ঘাড়ে। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে অলাভজনক বা লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত কুষ্টিয়া চিনিকলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রাখা অনিবার্য হয়ে পড়ে।

চাষাবাদে অতি উর্বর কুষ্টিয়ার মাটিতে আখ চাষের সেরামানের পরিবেশ থাকায় ১৯৬১ সালে ২২১ দশমিক ৪৬ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া চিনিকল। ১৯৬৫-৬৬ অর্থবছর থেকে শুরু হয় আখ মাড়াই কার্যক্রম। পরে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার।

কুষ্টিয়া চিনিকলের কারখানা শ্রমিক মিনাপড়ার বাসিন্দা রেজাউল করীম (৭৫) বলেন, শুরু থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরির শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী মিলে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষের আয় রোজগারের কেন্দ্র ছিল এ প্রতিষ্ঠানটি। চলছিলও ভালোই, লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের অযত্ন আর অবহেলা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার ফলে এ প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসান দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো।

কর্তৃপক্ষ দোষ দেয় শ্রমিক সংগঠনকে শ্রমিকরা দোষারোপ করে কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকে। বন্ধ হওয়া কারখানাটি এখন আস্তে আস্তে মাটিতে মিশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। এতো বড় একটা কারখানা চোখের সামনে ধ্বংস স্তূপ হয়ে যাচ্ছে কারখানার সেডগুলি খসে পড়ে যাচ্ছে অথচ দেখার কেউ নেই।

আখ চাষি জালাল মণ্ডল আক্ষেপ করে বলেন, ক্ষতিকর জেনেও আমরা জমিতে বাৎসরিক আর্থিক ফসল আখচাষ করে মিলে এসে হয়রানি ভোগান্তির কারণে আখচাষ মাঠ থেকে তুলে দেয় কৃষকরা। তামাক কোম্পানিরা যেখানে টাকা, সার বীজসহ সবরকম সাহায্য করে চাষিদের চিনিকলের লোকজন তার সম্পূর্ণ উল্টা। সেজন্যই মিলটার এই দুরবস্থা।

শ্রমিক উন্নয়ন সহ-সভাপতি সাগর আহমেদ বলেন, কোন শ্রমিক কখনও চাইবে না তার কর্মপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাক। এখানে কেবলমাত্র শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকলেই চলবে না। একই সঙ্গে চিনিশিল্প কর্পোরেশনকে আন্তরিক সুদৃষ্টি দিতে হবে। কর্পোরেশনের দায়িত্বহীনতার ফলে প্রতিবছরই উৎপাদিত চিনি গুদামজাত থেকে অবিক্রিত থাকায় একদিকে শ্রমিক তার বকেয়া বেতন, বোনাস, ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে অন্যদিকে কৃষক তার আখের দাম পেতে হয়রানির মুখে আখচাষে নিরুৎসাহিত, আবার অর্থসংকটে মিলের সংস্কার কাজও আটকে যাওয়া, সবমিলিয়ে এক অনিশ্চিত শংকায় দিন কাটছে।

বন্ধ হয়ে যাওয়া কুষ্টিয়া চিনিকলের দেখভালের দায়িত্বরত (কারখানা ইনচার্জ) হাবিবুর রহমান সব সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা কারণে কারখানা ভবনের এই জরাজীর্ণতা কথা চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। উনারা কয়েকবার এসে পরিদর্শনও করে গেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলি মেরামতের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ হয়নি। অর্থ বরাদ্দ পেলেই ভেঙে যাওয়া বা উড়ে যাওয়া চালাসহ ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সংস্কার করা হবে।

টিএইচ